বিজ্ঞাপন
রাজশাহী প্রতিনিধি
রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা ইউনিটে কর্মরত যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা করতেন পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরী। বিভাগীয় কোটা ও শিক্ষা সনদের মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল থেকে রাতারাতি হয়ে যান উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা।
জানা গেছে , দীর্ঘ দুই যুগ থেকে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার হিসেবে বহাল তবিয়তে চাকুরী করছেন সাঈদ আলী রেজা। এই মিথ্যা তথ্যে ২৪ বছর চাকুরীর কারণে সরকারের প্রায় কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন যুব উন্নয়ননের এই কর্মকর্তা।
যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজার ভূয়া বিভাগীয় কোটা ও শিক্ষা সনদের মিথ্যা তথ্যের বেশকিছু ডকুমেন্ট এই প্রতিবেদকের হাতে আসে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধানে তার সত্যতাও মিলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া ইউনিট থানা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হুমায়ুন রেজা মিঞার ছেলে। রেজা ১৯৮৬ সালে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাঁদপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে পুলিশ কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকুরীরত ছিলেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ‘যুব প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান’ প্রকল্পের আওতায় লোকবল নিয়োগের জন্য বেশ কিছু উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী , এই পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল- কোন বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অথবা বিভাগীয় প্রার্থীর ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রীধারী এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে কমপক্ষে ৩ বছরের বাস্তব চাকুরীর অভিজ্ঞতা।
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির উপরোক্ত শর্তাবলী সম্পন্ন না হলেও মোহা. সঈদ আলী রেজা পুলিশ কনস্টেবল পদে থেকেও মিথ্যা ও ভুয়া বিভাগীয় প্রার্থী এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উচ্চ পদস্থ এক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পদে বাগিয়ে নেন চাকুরী। অথচ বিভাগীয় প্রার্থী না হওয়ায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্ত অনুযায়ী তাঁকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে উক্ত পদের জন্য আবেদন করে চাকরিও পেয়ে যান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাঈদ আলী রেজা পুলিশ কনস্টেবল পদে সরকারি চাকুরিরত অবস্থাতেই বিভাগীয় কোন রকম অনুমোদন ছাড়া নিয়মিত ছাত্র সেজে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার রহনপুর ইসলামীয়া কলেজ থেকে ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন। একইভাবে ১৯৯১ সালে বি. এ. ডিগ্রী লাভ করেন। পরে ২০০৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ‘এশিয়ান ইউনিভার্সিটি’ থেকে করেন এমএ পাশ। কিন্তু সরকারি বিধি অনুযায়ী- চাকরিরত অবস্থায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণও সম্পূর্ণ বেআইনী। এজন্য তাঁর অর্জিত সনদপত্র দুটি আইন অনুযায়ী বৈধ নয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রেজা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও নিয়মবহির্ভুতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রালয়ের অধীন বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে চাকুরি নেন। এই অনিয়মের কারণে তার চাকরি প্রকল্প থেকে রাজস্বখাতের সময় স্থগিত করেন পিএসসি। সেই সময় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরকে পত্রও প্রদান করেছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তর। ওই সময় সারা বাংলাদেশের ২৪ জন থানা/উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার চাকুরী নিয়মিতকরণ ও স্থায়ীকরণ পিএসসি স্থগিত করে। সেখানেও সংশ্লিষ্ট ওই দপ্তরে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেন তিনি। পরে ওই দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে এবং তাঁর নিজ দপ্তরের কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে চাকুরি প্রকল্প থেকে চাকুরি নিয়মিতকরণ ও স্থায়ীকরণ করে নেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, রেজার চাকুরী স্থায়ীকরণের পর ২০১৩ সালের গ্রেডিয়েশানে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়েছে বিএ পাশ। আর ২০২১ সালের সর্বশেষ গ্রেডিয়েশানে আবারও উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য দিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়েছেন ১৯৯১ সালে স্মাতকোত্তর পাশ। যদিও তিনি ২০০৮ সালে এশিয়ান ইউনির্ভাসিটি থেকে স্মাতকোত্তর পাস করেন।
২৪ বছরে বিভিন্ন কর্মস্থলে চাকুরিকালীন অধীনস্থ কর্মচারীদেরকে ভযভীতি প্রদশন ও নানা কৌশলে করেন কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ থাকলেও ভয়ে কোন কর্মচারি মুখ খুলতে সাহস পান না। তার দপ্তরের একাধিক কর্মচারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বললে হামলা ও নানাভাবে হয়রানি শিকার হতে হয়। এছাড়াও উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে ভুল বুঝিয়ে দূরে কোথাও বদলী করান।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক সূত্রে জানা যায়, চাকুরীকালীন বিভিন্ন কর্মস্থলে, আসবাবপত্র, কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী ক্রয়, মোটরযান মেরামত, তেলের বিল, প্রশিক্ষণের সম্মানি ভাতা, প্রশিক্ষণ উপকরণ, ভ্রমন ব্যায়সহ বিভিন্ন খাতে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ২৪ বছরে করেছেন কয়েক কোটি টাকার দুর্নীতি। সংগঠন তালিকাভুক্তি ও নিবন্ধনের কাজ করেন অর্থের বিনিময়ে এবং শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠকের পুরস্কার নিয়ে দিবেন বলে লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন ঋণ যুবকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন বলেও ওই সূত্র জানান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বোয়ালিয়া থানা ইউনিটে কর্মরত যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা সঈদ আলী রেজা কালবেলাকে বলেন, ‘এইসব অভিযোগ মিথ্যা, আমি কোন জালিয়াতির আশ্রয় নেয়নি। আমি যথাযত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই চাকুরি নিয়েছি।’ পুলিশের চাকুরি করে কীভাবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিভাগীয় প্রার্থী হয়ে চাকরিতে যোগদান করলেন; এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কোন কথা বলবো না, এই ২৪ বছরে অনেকবার অনেক কথা হয়েছে। আমার উধর্বতন কর্তৃপক্ষই এর সঠিক জবাব দিতে পারবে।’
জানতে চাইলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপ-পরিচালক এ.টি.এম গোলাম মাহবুব বলেন, ‘ওনার (সঈদ আলী রেজা) কীভাবে চাকুরী হয়েছে তা বলতে পারবো না। এই বিষয়ে আমাদের উর্ধতন কর্তৃপক্ষই বলতে পারবে। তার বিরুদ্ধে এর আগে দুটি লিখিত অভিযোগ এসেছিল। সেটা মিমাংসা করে দিয়েছি।’
রাজ/শফিকুল/৩৩
প্রতিমুহুর্ত্বের খবর দ্রুত পেতে পেজে লাইক দিয়ে আমাদের সাথেই থাকুন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিধি মোতাবেক নিবন্ধনের জন্য আবেদিত